যৌনকর্মীদের পেশার জন্য তাদের সন্তানরা কেন সমাজে ঘৃণিত হবে?- এমন ভাবনাই আসে হাজেরা বেগমের মনে। পূর্বে যৌনকর্মী পেশায় থাকা এ জীবনের কালো অধ্যায়গুলো খুব কাছ থেকেই দেখেছিলেন। তাই এ পেশার নারীদের সন্তানদের সুন্দর জীবন নিশ্চিতে নিজ উদ্যোগে একটি আবাসন গড়ে তোলেন। তিনি জানতেন, যৌনপল্লীর পরিবেশে বড় হলে অঙ্কুরেই নষ্ট হয়ে যাবে এই শিশুদের ভবিষ্যৎ। তার এই উদ্যোগে সঙ্গী হয়ে পাশে দাঁড়ায় ‘গিভ বাংলাদেশ’ নামের এক সংগঠন।

ছবি: সৌজন্যেপ্রাপ্ত

‘আজকের শিশু, আগামীর ভবিষ্যৎ’-এই কথাটি কি সব শিশুদের বেলায় খাটে? এই যে রাস্তার পাশে পড়ে থাকা ছোট্ট শিশুরা দু’বেলা ক্ষুধার অন্ন জোগান হয় না যাদের। যাদের কপালে জোটেনা শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা – তাদের ভবিষ্যত তাহলে কী? আমাদের সমাজ বাস্তবতায় ছিন্নমূল পথশিশুরা সমাজের প্রতিটি স্তরে বৈষম্যের শিকার হয়। আর যেসব শিশুদের জন্মটা হয় সামাজিক স্বীকৃতি ও পিতৃপরিচয়হীন, তাদের জন্যে এ সমাজ যেন- আরও হিংস্র ও কঠিন এক পৃথিবী। তাদেরও কি আমাদের সমাজ আগামীর ভবিষ্যৎ হিসেবে গণ্য করে!

অন্য শিশুদের মতো এই শিশুরা শৈশবে নানারকম সুযোগ-সুবিধা পেয়ে বড় হয় না। তাদেরকে সমাজে মূল্যায়ন করা হয় না। জীবনের জটিল-কঠিন ধাঁধা বোঝার আগেই এই শিশুরা অবহেলা আর দশজনের চোখে ঘৃণার ভাষা দেখতে দেখতে বড় হয়।

বাংলাদেশের সামাজিক ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে যৌনকর্মী পেশাকে মানুষ ঘৃণার চোখে দেখে। এ পেশার সাথে জড়িত মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা ও তাদের জীবনমান উন্নয়নে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই রাষ্ট্র, সমাজ ও স্বচ্ছলশ্রেণীর পক্ষ থেকে। কিন্তু, তাই বলে এই পেশায় নিয়োজিতদের মন্দচোখে দেখতে ছাড়ে না কেউই।  যৌনকর্মীদের সন্তানদের জীবনেও তাদের পেশা কালো ছায়া ফেলে।

ছবি: সৌজন্যেপ্রাপ্ত

যৌনকর্মীদের কাজের জন্য তাদের সন্তানরা কেন সমাজে ঘৃণিত হবে?- এমন ভাবনাই আসে হাজেরা বেগমের মনে। পূর্বে যৌনকর্মী পেশায় থাকা এ জীবনের কালো অধ্যায়গুলো খুব কাছ থেকেই দেখেছিলেন। তাই এ পেশার নারীদের সন্তানদের সুন্দর জীবন নিশ্চিতে নিজ উদ্যোগে একটি আবাসন গড়ে তোলেন।  তিনি জানতেন, যৌনপল্লীর পরিবেশে বড় হলে অঙ্কুরেই নষ্ট হয়ে যাবে এই শিশুদের ভবিষ্যত।  তার এই উদ্যোগে সঙ্গী হয়ে পাশে দাঁড়ায় ‘গিভ বাংলাদেশ’ নামের এক সংগঠন। গিভ বাংলাদেশ ‘প্রজেক্ট পথচলা’ নামের একটি প্রকল্প চালু করে এই শিশুদের মানসিক বিকাশ ও সামাজিক অবস্থান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে।  দীর্ঘ ৮ বছর ধরে চলছে তাদের এই কার্যক্রম।

‘গিভ বাংলাদেশ’ সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক খন্দকার আবির হোসেইন তাদের কার্যক্রম নিয়ে সারসংক্ষেপে বলেন, ‘ছোট থেকেই এই শিশুদের মানসিক বিকাশ করা সম্ভব হলে, বড় হয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগবে না। সঠিক দিকনির্দেশনা ও শিক্ষার ব্যবস্থা করা গেলে- তারাও একদিন সমাজে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে তুলতে পারবে এবং অন্যদের মতো সমাজে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে।  এজন্যে প্রথমেই যৌনপ্ললীর পরিবেশ থেকে তাদেরকে  দূরে সরিয়ে আনতে হবে।  যৌন পেশায় থাকা মায়েরা চান না- তাদের সন্তানরা সমাজের অন্যদের সাথে মিশুক, বা অন্য কাজ করুক।  কারণ তাদের মধ্যে সবসময় সংশয় কাজ করে যে, তাদের যেহেতু সমাজ ঘৃণার চোখে দেখে – তাই তাদের সন্তানদের সমাজের অন্য পেশায় জায়গা হবে না।  তাই এসব শিশু যেন পড়াশোনার মাধ্যমে নিজেরা সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং এই পেশা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে, তা নিশ্চিত করতেই ‘প্রজেক্ট পথচলা’ তাদের পাশে রয়েছে’।

ছবি: সৌজন্যেপ্রাপ্ত

 ‘প্রজেক্ট পথচলা’ পরিচয়হীন শিশুদের দিচ্ছে সামাজিক ও মানসিক শিক্ষা  

একই পৃথিবীর দুই মেরুকরণ; যৌনপল্লীতে জন্ম নেওয়া একটি শিশুর বেড়ে উঠা আনন্দ ও ভালোবাসায় মোড়ানো থাকে না।  এ বাস্তবতায়, সারাদেশের যৌনপল্লীর শিশুদের মানসিক শিক্ষা ও অন্যান্য সহায়ক সুবিধা দেওয়ার লক্ষ্যে ২০১৪ সালে গিভ বাংলাদেশ সংগঠনের ছায়াতলে ‘প্রজেক্ট পথচলা’ চালু করা হয়।

যৌনপল্লীতে জন্ম নেওয়া শিশুদের অন্ধকার ঐ জগত থেকে দূরে রাখতে হাজেরা বেগম ‘শিশুদের জন্য আমরা’ নামের একটি আবাসন ঠিকানা গড়ে তুলেছেন, যেখানে প্রজেক্ট পথচলা নিরলস কাজ করে যাচ্ছে শিশুদের জন্য। ঢাকার আদাবরের এই আবাসনে বর্তমানে ৪৫ জন ছেলেমেয়ে রয়েছে। এখানে থাকা, খাওয়া, শিক্ষা ও চিকিৎসার সুবিধা পায় এই শিশুরা। কেবল ৫-১৮ বছর বয়সীদের এই আবাসস্থলে রাখা হয়। ১৮ বছরের পর কর্মমুখী শিক্ষার প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়া হয় ।

আবির আরও বলেন, ‘করোনাকালীন আমরা ঢাকার ভাসমান যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করেছি।  সেসময় এই মানুষগুলোর জীবিকার পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের পাশে দাঁড়াতে ‘গিভ বাংলাদেশ’ খাবার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর ব্যবস্থা করে দেয়।  কামরুন্নেসা ফাউন্ডেশন (কেকে) ও প্রজেক্ট পথচলার যৌথ উদ্যোগে ভাসমান যৌনকর্মীর সন্তানদের জন্যে উত্তরায় একটি আবাসন গড়ে তোলা হয়েছে।  ‘জয় সকল শিশুর’ নামক এই আবাসন ঠিকানায় বর্তমানে ৯ জন শিশুকে রাখা হয়েছে। শিশুদের আনার পূর্বে তাদের মায়েদের সাথে চুক্তি করে নেওয়া হয়। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, মায়েরা তাদের সন্তানদের যৌন পেশায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারবেন না এবং এখান থেকে নিয়ে যেতে পারবেন না।  কিন্তু, কিছুদিন যাওয়ার পর অনেকেই মাঝপথে বেঁকে বসেন। একটু বড় হওয়ার পর সন্তানদের নিজ পেশায় লাগিয়ে অর্থ উপার্জন করতে চান কেউ কেউ। তাদের এই চিন্তার পরিবর্তন আনতে আমরা সন্তানদের পাশাপাশি তাদের মায়েদের দায়িত্ব নিতে শুরু করলাম। অর্থাৎ, মায়েদের বিভিন্ন কাজের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে তাদের জীবিকার পথ তৈরি করে দেওয়া।  এরই ধারাবাহিকতায়, এপর্যন্ত প্রায় ৫০ যৌনকর্মী নারীকে সেলাই কাজের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে’।

ছবি: সৌজন্যেপ্রাপ্ত

মানসিক বিকাশ হোক খেলার ছলে 

‘প্রজেক্ট পথচলা’ সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ক্যাম্পেইন চালায়।  ‘উৎসর্গ করুন আপনার পুরোনো, অব্যবহৃত বই’ এই শিরোনামে করা একটি পোস্টে সাড়া দেয় অসংখ্য মানুষ।  ইতোমধ্যে লাইব্রেরি গড়ে তোলার জন্যে জমা পড়ে নগদ অর্থ ও দুই হাজারের ওপর বই।  বইগুলো দিয়ে দৌলতদিয়ায় অবস্থিত শিশুপল্লীর জন্যে নির্মাণ করা হয়েছে একটি পাঠাগার।  ছোটবেলা থেকেই বইয়ের রাজ্যে বিচরণের মাধ্যমে এই শিশুরা যেন নিজেদের জ্ঞান, চিন্তাশক্তির বিকাশ ঘটাতে পারে, সে জন্যেই এ উদ্যোগ।  যেসব বাচ্চাদের ছোটবেলা থেকে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হয়, তারা বই পাবে কোথায়? তাই অন্যদের পড়ে ফেলা ও ঘরের কোণে জমিয়ে রাখা বইগুলো দিয়েই গড়ে তোলা হচ্ছে একদল শিশুর জন্য নতুন আনন্দ।  পাঠাগারমুখী ও বইয়ের প্রতি শিশুদের আগ্রহী করে তুলতে প্রতি মাসে ‘প্রজেক্ট পথচলা’ আয়োজন করে নানান প্রোগ্রামের।

মগজ ধোলাই

প্রতিবছর ‘প্রজেক্ট পথচলা’ দৌলতদিয়া যৌনপল্লীর বাচ্চাদের নিয়ে বই পড়া, হস্তশিল্প ও ছবি আঁকা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে থাকে। দুটি বই নির্ধারণ করে সেই বইয়ের ওপর নেওয়া হয় কুইজ।  বাচ্চাদের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস ধরে রাখতে প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া ও বিজয়ীদের জন্যে থাকে নানা পুরস্কারের ব্যবস্থা। গত ১৭ ডিসেম্বর দৌলতদিয়ায় আয়োজিত ‘মগজ ধোলাই ৪.০’ প্রোগ্রামে অংশ নেয় ৮০ জন শিশু। ‘প্রজেক্ট পথচলা’ এযাবৎ এক হাজার ৪৫০ জন যৌনকর্মীর বাচ্চাদের নিয়ে ১৫০টি সেশন পরিচালনা করেছে। সেশনগুলোয় বাচ্চাদের দেওয়া হয়েছে পাঠ্যপুস্তকের শিক্ষাসহ নানাবিধ মানসিক শিক্ষা।

ছবি: সৌজন্যেপ্রাপ্ত

এতসব উদ্যোগ ও কর্মসূচি পরিচালনায় প্রয়োজন হয় অর্থ ও তহবিলের। এই ফান্ডের বিষয়ে আবির জানান, ‘সরকারি কোনো অনুদান এপর্যন্ত আমরা পাইনি। এনজিওগুলো  বিভিন্ন সরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে ফান্ড পেয়ে থাকে, যার জন্য তাদের কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়। সংগঠন হিসেবে নিবন্ধন হওয়ায় আমাদের অর্থের প্রধান উৎস হচ্ছে, ব্যক্তি পর্যায় থেকে প্রতিদিন বা মাসিক হারে আসা একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের অনুদান।  কেউ কেউ আবার একজন করে বাচ্চাদের দায়িত্ব নিয়েছেন। অর্থাৎ, ওই বাচ্চার যাবতীয় খরচ তারাই বহন করেন। এছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্যাম্পেইন চালিয়ে অর্থ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সেবা সংগ্রহ করা হয়। তবে বেশিরভাগ মানুষ যখন জানতে পারেন এই অর্থ যৌনকর্মীর বাচ্চাদের জন্য, তখন অনেকেই অর্থ সহায়তা দিতে চান না। এই পেশার সাথে জড়িত মানুষদের সাহায্য করতে অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নেন’।

আস্থা অর্জন 

যৌনকর্মীরা সমাজে এতবেশি অবহেলা আর তিরস্কারের শিকার হয়েছেন, যে তারা সমাজের অন্য মানুষদের সহজে ভরসা করতে পারেন না। সমাজ যেমন তাদের নিয়ে গৎবাঁধা চিন্তা করে, তেমনি এই মানুষগুলোও সমাজের অন্যদের আপন ভাবতে ভয় পায়। তাই নিজদের সন্তানদের অপরিচিতদের আশ্রয়ে রাখতে ভরসা পান না অনেক মা।

 

ছবি: সৌজন্যেপ্রাপ্ত

‘প্রজেক্ট পথচলা’ কীভাবে মায়েদের বিশ্বাসের জায়গা অর্জন করছে তা জানাতে আবির বলেন, ‘স্থানীয় ও পূর্বে এই পেশায় ছিলেন এমন ব্যক্তিদের সাহায্য নিয়ে কাজটি করা হয়। তাদের মাধ্যমে মায়েদের সাথে যোগাযোগ করলে তারা নিজেদের সন্তান দিতে রাজি হোন। রিনা বেগম নামের একজন ভাসমান যৌনকর্মী মুগদায় ‘বাঁচতে চাই’ নামের একটি আবাসন গড়ে তুলেছেন। তার মাধ্যমে আমরা অন্যান্য ভাসমান যৌনকর্মীর সন্তানদের দায়িত্ব নিই। যাদেরকে বর্তমানে উত্তরায় একটি আবাসনে রাখা হয়েছে। সন্তানদের পাশাপাশি ভাসমান যৌন পেশায় নিয়োজিত নারীদের নানা আইনি পরামর্শ ও জরুরি স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়’।

২০২৩ সালের মধ্যে ‘প্রজেক্ট পথচলা’ দৌলতদিয়া থেকে আরও কয়েকজন শিশুকে উত্তরার আবাসনে আনার জন্যে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, সব ঠিকঠাক থাকলে এই বছরে তারা দৌলতদিয়া ও টাঙ্গাইলে শিশুদের নিয়ে মগজ ধোলাই প্রোগ্রামের আয়োজন করবে। সমাজের এত সংখ্যক মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। আর এই কাজটি সময় সাপেক্ষ। ‘প্রজেক্ট পথচলার’ লক্ষ্য হচ্ছে- এই শিশুদের ভাগ্য পরিবর্তনের মাধ্যমে তাদের সুন্দর ভবিষ্যত গড়ে তোলা। এই শিশুরাও যাতে সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে, তা নিশ্চিতে শুরু থেকেই কাজ করে যাচ্ছে সংগঠনটি।